
সাধারণ ভব্যতাও যখন লোপ পেয়ে যায়-কামরুল হাসান বাদল-কবি ও সাংবাদিক
পোস্ট করা হয়েছে 30/09/2016-07:35am: ১। খুব সাধারণ একটি খবর। খুব বড় জোর কোনো সংবাদপত্রের যে কোনো পৃষ্ঠায় সিঙ্গল কলাম নিউজ হওয়ার মতো ব্যাপার। ‘এগার বছর পর সঙ্গী পেল সিংহ’ ধরনের শিরোনাম হতে পারতো যা। তাই হয়ে উঠল প্রায় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের মতোই । যে চিড়িয়াখানায় এখনো বন্যপশুদের উপযোগী ও মানসম্মত পরিবেশ তৈরি করা যায়নি। যে চিড়িয়াখানায় পশুদের জন্য নির্ধারিত খাদ্য না দিয়ে টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগ আছে, সেই চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ আদিখ্যেতার শেষ দেখালেন সিংহ আর তার জন্য সংগ্রহ করা সিংহিকে নিয়ে। ব্রেকিং নিউজ দিতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত কিছু কিছু টিভি চ্যানেল এবার হামলে পড়ল বেচারা সিংহের ওপর। হাজার ওয়াটের ফ্লাট লাইট, ফ্ল্যাশ আর ক্যামেরার সার্বক্ষণিক লক্ষ হয়ে উঠল সকল কিছু বোঝার অক্ষম বন্য প্রাণিটি। তার আগে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ খুব ঘটা করে সাংবাদিক ভাইদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। স্কুলে স্কুলে নোটিশ পাঠিয়েছেন শিক্ষার্থীদের ব্যানারসহ উপস্থিত থাকার। সিংহ-সিংহির কথিত বিয়ে উপলক্ষে অনুষ্ঠানস্থল সাজানো হয়েছে। কলিজা দিয়ে তৈরি কেকের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারও করল কয়েকটি টিভি চ্যানেল। কিছু কিছু পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল এই পশু দম্পতির বাসররাত সংক্রান্ত সংবাদও প্রচার করলো অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে। আমি রাতে টেলিভিশনের প্লাগ খুলে রাখলাম। ডিশ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখলাম। প্রিয় পাঠক, আমার গুস্তাফি হলে মাফ করবেন। আমি ভয় পেয়েছিলাম, মধ্যরাতে যদি লাইভ কিছু দেখায় টিভিওলারা। সংবাদ মাধ্যমে ‘সেল্প সেন্সরশিপ’ বলে একটি কথা আছে। রাস্ট্রীয় নীতিমালা ও সরকারি বিধিনিষেধ ছাড়াও কিছু কিছু সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিক বা সম্পাদক ‘সেল্প সেন্সরশিপ’ আরোপ করেন। কোন সংবাদ প্রচার হবে কিনা, হলেও তা কতটুকু এবং কীভাবে হবে, সংবাদে কোন ধরনের তথ্য বা শব্দ ব্যবহার করা হবে, কোন ধরনের ছবি ব্যবহার করা ইত্যাদি বিষয়। অভিজ্ঞতা ও দায়িত্ববোধ থেকে সংবাদকর্মীরা নিজেরাই তা করে থাকেন। ব্রেকিং নিউজ, সর্বশেষ সংবাদ ও সরাসরি সম্প্রচারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আমাদের টেলিভিশনগুলো এসব আদৌ জানে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কোন সংবাদ কতটুকু গুরুত্ব পাবে কিংবা কোন ছবিটি প্রচার করা যাবে এই সাধারণ জ্ঞানটুকুও অনেকের থাকে না দেখে বিস্ময় জাগে। একটি আধা আদিম সমাজের মতো সিংহের জন্য একটি সঙ্গী সংগ্রহের সংবাদটি ‘বাসররাত’ এর সংবাদ পর্যন্ত গড়ালো। আমাদের রুচির দৈন্য যে কতটা প্রকট হয়ে উঠেছে এটিই তার প্রমাণ। ২। সম্প্রতি সংবর্ধনার বন্যা দেখে দেশের মানুষ বেশ কৌতূহল বোধ করছেন। চট্টগ্রামের বিদায়ী জেলা প্রশাসক দিনেই আধাডজন সংবর্ধনা নিয়ে কৃতার্থ করেছেন চট্টগ্রামবাসীকে। উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে প্যাড সর্বস্ব সংগঠনের সংবর্ধনা নিতে নিতে তিনি হাঁফিয়ে উঠেছিলেন কিনা জানি না তবে সংবাদপত্রে সে দৃশ্য দেখতে দেখতে পাঠকরা হাঁফিয়ে উঠেছেন। ঠিক একই সময়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রসাশক আরও কয়েকধাপ এগিয়ে মুকুটসহ রাজকীয় পোশাক পরিধান করে সিংহাসন সদৃশ চেয়ারে বসে সংবর্ধনা গ্রহণ করে দেশবাসীকে চমকে দিয়েছেন। একেই বলে জনগণের সেবক, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী (!) । জেলা প্রশাসকরা তাদের চাকরি সুবাদে বিভিন্ন জেলায় আসবেন, যাবেন। এবং সে সাথে তাঁর ওপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কর্ম সম্পাদন করবেন। এর বিনিময়ে তিনি সরকার থেকে বেতন পান, ভালো কাজের জন্য দ্রুত প্রমোশন পান, চাকরি শেষে এককালীন প্রচুর টাকাও পান। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন না। যা করেন তা চাকরির স্বার্থেই করেন। কাজেই একজন সরকারি কর্মকর্তা তা চাকরির কাজের জন্য সংবর্ধনা কেন পেতে পারেন তা বোধগম্য নয়। এটা সরকারি চাকরি বিধির লঙ্ঘনও বটে। মধ্যরাতে কোথাও আগুন লাগলে সেখানে ছুটে যেতে হয় দমকলবাহিনীর লোকদের। খবর সংগ্রহের জন্য সাংবাদিকদের। এখন তাই বলে কি পত্রিকা বা টেলিভিশনে তাদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে এইভাবে এ আগুনের খবর পেয়ে বিছানা ছেড়ে ঘটনাস্থলে গেলেন.....। সমস্যা হচ্ছে এদেশের মানুষ ‘সাহসকে’ দুঃসাহস বলে। সাধারণ কাজগুলোকেই ‘মহৎ কাজ’ বলে। এখানে রাস্তাঘাটে বেকার ঘুরে বেড়ালে আর দুএকটি শালিস-বিচার করলে তাদেরকে সমাজসেবক বা সমাজ সংস্কারক বলে। এখানে সাধারণ একজন লেখককে বিশিষ্ট লেখক বলে, এখানে দুচারটি গান গাইলে তাকে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী বলে। এখানে সবাই বিশিষ্ট সাংবাদিক। এখানে জনগণের অর্থ মেরে দেওয়া ব্যক্তি জনগণের বন্ধু। এখানে অবৈধ অর্থবিত্তের মালিক সর্বজন শ্রদ্ধেয়। এখানে ব্যাংকের ঋণ খেলাপি দানবীর হিসেবে সম্মানিত হন। এখানে কে কাকে সংবর্ধনা দেবে, কে কেন সংবর্ধনা নেবেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এখন সংবর্ধনার কাল। এখন ক্রেস্ট বন্যায় ভেসে যাওয়ার কাল। এখন তোষামোদ ও স্তুতি করার কাল। এই শহরে প্রতিমাসে বেশ কিছু সংবর্ধনার অনুষ্ঠান হয়। উদ্যোক্তারা কে? তাঁরা কোথা থেকে এসেছেন এবং তাঁরা কেন, কাদের সংবর্ধনা দিচ্ছেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। এইসব অনুষ্ঠানে সংবর্ধিতরা গলায় মালা, হাতে ক্রেস্ট, কাঁধে উত্তরীয় নিয়ে দিব্বি হেসে হেসে ছবি তুলতে ভালোবাসেন। চট্টগ্রামে এ ধরনের বেশকিছু সংগঠন আছে। যাদের কাজ হলো সংবর্ধনার আয়োজন করা। এরা কখনো কখনো এক সাথে ত্রিশ জনকেও সংবর্ধনা দেন। এরমধ্যে দুএকজনকে চেনা গেলেও বাকিদের চেনা যায় না। আয়োজকরা সংবর্ধিতদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁদেরই সংবর্ধনা দেন। এঁরা দশ/ বিশ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি পাঁচশ টাকার ক্রেস্ট নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফেরেন। জাতীয় চার নেতার নামে একটি সংগঠন আছে যারা একবার ৩২ জনকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন বলে শুনেছি। আগে দেখতাম, এখনও দেখি সংবর্ধনার জন্য মুখিয়ে থাকেন রাজনীতিকরা, জনপ্রতিনিধিরা। তাঁদের সংবর্ধনা প্রদানের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিশুদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রখর রোদে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখার সংবাদও আমরা দেখেছি। অনেকে রাজকীয় সংবর্ধনাও নিয়েছেন। সোনার নৌকাও নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশের পর সরকারদলীয়দের মধ্যে এই প্রবণতা হ্রাস পেলেও এখন এই রোগে পেয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের। একজন জেলা প্রশাসকের দেখাদেখি এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়াবে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যন্ত। জনগণের তাতে কী লাভ হবে জানি না তবে ফুল ও ক্রেস্ট বিক্রেতারা কিছুটা লাভবান হতে পারেন তাতে। এসব দেখে শুনে মনে হয় আমাদের বোধশক্তির প্রচণ্ড ঘাটতি আছে। শোভনতা, শালীনতা ভব্যতা আমাদের সমাজ থেকে দ্রুত লোপ পাচ্ছে। সোজা বাংলায় বলতে গেলে চক্ষু লজ্জা বলে এখন আর কিছুই নেই। আমরা এখন যে কোন কাজ করতে দ্বিধাবোধ করি না। সংকোচ বোধ করি না। এ যেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য এক জাতি। যাঁকে সম্মান করার তাঁকে করছি না। অপাত্রে মাল্যদান করছি। ৩। গতকাল ছিল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ৭০তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি। বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থে তাঁর দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা প্রয়োজন। শেষ করার আগে একটি কথা বলি- এখনো একুশের চেতনায় যে বাংলাদেশ আছে, এখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় যে বাংলাদেশ আছে; এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে বাংলাদেশ আছে, এখনো ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক যে বাংলাদেশ আছে, এখনো মানবিক যে রাষ্ট্রটি আছে, এখনো অগ্রগতির পথে যে বাংলাদেশটি আছে, তার কারণ হলো এখনো আওয়ামীলীগ আছে। আর আওয়ামী লীগ এখনো যে আওয়ামী লীগ আছে তার কারণ হলো এর নেতৃত্বে শেখ হাসিনা আছেন। অর্থাৎ শেখ হাসিনা আছেন বলেই এখনো একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ আছে। কিন্তু সমস্যা হলো বাঙালি কাকে সম্মান জানাবে, কাকে বাঁচিয়ে রাখবে সেটিই জানলো না। সে মালা কাকে পরাবে তা-ও শিখলো না। email: [email protected]